স্টাফ রিপোর্টার :
ভোটকেন্দ্রগুলোতে চোখে পড়ার মতো ভোটার উপস্থিতি ছিল না। ছিল না শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। এমন ফাঁকা মাঠেই ঢাকা-১৭ আসনে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাত। ১২৪ কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকে তিনি পেয়েছেন ২৮ হাজার ৮১৬ ভোট। মোট ভোটারের ৮.৮৬ শতাংশ ও প্রদত্ত বৈধ ভোটের ৭৭.৮০ শতাংশ পেয়ে কয়েক মাসের জন্য জনপ্রতিনিধি হলেন তিনি। তার নিকটতম স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম একতারা প্রতীকে পেয়েছেন ৫৬০৯ ভোট। নির্বাচনে ভোট পড়েছে ১১.৫১ শতাংশ। সোমবার রাতে রাজধানীর বনানী বিদ্যা নিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বেসরকারি ফল ঘোষণা করেন ঢাকা-১৭ আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. মুনীর হোসাইন খান। ফল ঘোষণার সময়ে সেখানে মোহাম্মদ এ আরাফাত উপস্থিত ছিলেন না।
ঢাকা-১৭ আসনে সোমবার সকাল ৮টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ হয়। প্রতিটি কেন্দ্রে ছিল সিসি ক্যামেরা। সেগুলোর মাধ্যমে ভোট সরাসরি মনিটরিং করে ইসি। কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। কেন্দ্রের বাইরে নৌকা প্রতীকের ব্যাজধারী ছাড়া অন্য প্রার্থীর সমর্থকদের তৎপরতা দেখা যায়নি। ভোটগ্রহণ চলাবস্থায় বড় অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলেও বিকাল সোয়া ৩টার দিকে বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজে মো. আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমের ওপর নৌকা ব্যাজধারীরা হামলা করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই তাকে রাস্তায় ফেলে মারধর করা হয়। এর আগে সকালে সাড়ে ১০টার দিকে হিরো আলম নির্বাচনি পরিবেশ ভালো নয় বলে বক্তব্য দেন। ওই সময় তিনি দাবি করেন, তার এজেন্টদেরকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। হামলার পর নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. তরিকুল ইসলাম ভূঞা সকালেই নির্বাচনের পরিবেশ না থাকার কারণ দেখিয়ে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।
দুই প্রার্থী এমন অভিযোগ করলেও ভিন্ন কথা বলেছে নির্বাচন কমিশন। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর নির্বাচন ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। এ পর্যন্ত কোনো অশান্তির খবর আমরা পাইনি। হিরো আলমের ওপর হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ১২৪টি কেন্দ্রে ভোট হয়েছে। একটি কেন্দ্রের পরিস্থিতি দিয়ে তো বলা যায় না ভোট সুষ্ঠু হয়নি। আমরা সঠিক অবস্থাটা এখনো জানতে পারিনি। তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করায় দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি। ওই ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ইসি ব্যবস্থা নিতে বলেছে বলে তিনি জানান।
সরেজমিন ভোটগ্রহণ চিত্র : নির্বাচনি এলাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, ভোটার উপস্থিতি নেই বললেই চলে। কিছু সময় বিরতি দিয়ে দু-চারজন ভোটকেন্দ্রে এসে ভোট দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। ভোট শুরুর তিন থেকে চার ঘন্টা পরও অনেক ভোটকক্ষে একটিও ভোট পড়েনি। দীর্ঘ সময় ভোটার উপস্থিতি না থাকায় ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের অনেককে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় দেখা যায়। মহাখালী, সাততলা বস্তি, কড়াইল বস্তি, নর্দ্দা এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তৎপরতা বেশি ছিল। সেখানে নেতাকর্মীদের দীর্ঘ লাইন সাজিয়ে ভোটার উপস্থিতি বেশি তা প্রমাণেরও চেষ্টা করতে দেখা গেছে।
সোমবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে রাজধানীর গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর ভোটার উপস্থিতি নিয়ে কথা বলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাত। পাঁচ থেকে ছয় মাস মেয়াদের জন্য নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের অনীহা থাকে উল্লেখ করে আরাফাত বলেন, ‘এখানে আমরা অনুপ্রেরণা দেওয়ার চেষ্টা করছি, আগ্রহী করার চেষ্টা করছি। আশা করছি যথেষ্ট পরিমাণ ভোট আমরা সংগ্রহ করতে পারব।’
রাজধানীর মাটিকাটার ব্লু-বার্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে দুপুর ১টা ১০ মিনিটে দেখা যায়, ওই সময়ে কেন্দ্রে একজনও ভোটার নেই। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও পোলিং এজেন্টরা গল্পগুজবে মেতে আছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অলস সময় পার করছেন। ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামের তথ্য অনুযায়ী, ভোট শুরুর পাঁচ ঘণ্টায় (বেলা ১টা পর্যন্ত) ভোট পড়ে ১৫০টি। এ কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা দুই হাজার ৪৪৫ জন। ভোট পড়ার হার ছিল ৬.১৩ শতাংশ। প্রায় একই ধরনের দৃশ্য দেখা গেছে ২৬ নম্বর ভাসানটেক স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে। দুপুর ১টা পর্যন্ত এ কেন্দ্রে ভোট পড়ে ২৪০টি। ওই কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা ২৪২৩ জন। একই ভবনে অবস্থিত ২৮ নম্বর কেন্দ্রে একশর বেশি ভোট পড়ে। এ কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ২২৪৮ জন। দুই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তারা ভোট পড়ার তথ্য জানান। ৮৪ নম্বর সরকারি তিতুমীর কলেজ কেন্দ্রে বেলা ১১টা পর্যন্ত মাত্র ৯০টি ভোট পড়ে। ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মো. মেহেদী হাসান জানান, ১৯০৪ ভোটার সংখ্যার এ কেন্দ্রে সকাল থেকেই ভোটার উপস্থিতি ছিল না। একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৮৫ নম্বর কেন্দ্রে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ৭৯টি ভোট পড়ে।
ভিন্নচিত্র ছিল মহাখালীর ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৮৭ থেকে ৯১ নম্বর পর্যন্ত মোট ৫টি ভোটকেন্দ্র ছিল। প্রতিটি কেন্দ্রের ভেতরে ছাত্রলীগের তৎপরতা দেখা গেছে। বেলা সাড়ে ১১টায় বনানী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এইচএম মিরাজুল ইসলাম মাহফুজ কিছু সময় পরপরই বিপুলসংখ্যক অনুসারীকে কেন্দ্রে ঢুকিয়ে নিজেই তাদেরকে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেন। তাদের জন্য কেন্দ্রের ভেতরেই পানি ও বিস্কুটেরও ব্যবস্থা করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই তাদেরকে নৌকা ভোট দিতে নির্দেশনা দেন। কেন্দ্রের ভেতরে এমন তৎপরতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি অ্যাপের সাহায্যে নেতাকর্মীদের ভোটার নম্বর ও কোন কক্ষে ভোট দেবে তা বের করে দিচ্ছি। অনেকেই কক্ষ খুঁজে পায় না, তাই সহযোগিতা করছি। বুথের ভেতরে আমি যাইনি।’
এ প্রসঙ্গে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা রিপন রানা বলেন, ভোটগ্রহণ পরিস্থিতি ভালো। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়নি। ছাত্রলীগের তৎপরতার বিষয়ে তিনি বলেন, আমার সামনেই ওই কেন্দ্রে পুলিশের ইনচার্জ এসআই শুভকে বিষয়টি দেখার জন্য বলেন। কিছু সময় পর শুভ জানান, আইনশৃঙ্খলা বিষয়টি ইন্সপেক্টর জামান দেখছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইন্সপেক্টর জামান বলেন, একই ভবনে পাঁচটি কেন্দ্র হওয়ায় অনেক লোক একসঙ্গে প্রবেশ করছে। অনেকে ভুল করে এ কেন্দ্রে আসছে। এ কারণে এত ভিড় দেখা যাচ্ছে।
সব কেন্দ্রে নৌকার এজেন্ট ছিল, অনেক কেন্দ্রে ছিল লাঙ্গল ও একতারার এজেন্ট : সব কেন্দ্রেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট ছিল। পাশাপাশি অনেক কেন্দ্রে হিরো আলম, জাতীয় পার্টির সিকদার আনিসুর রহমান ও জাকের পার্টির কাজী মো. রাশিদুল হাসানের পোলিং এজেন্ট দেখা গেছে। ব্লু-বার্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ওই চার প্রার্থীর এজেন্ট পাওয়া গেছে। সরকারি তিতুমীর কলেজের তিনটি কেন্দ্রেই এই চার প্রার্থীর এজেন্ট পাওয়া গেছে। মাটিকাটার আইডিয়াল পাবলিক স্কুল কেন্দ্রে নৌকা, গোলাপফুল ও লাঙ্গল প্রতীকের এজেন্ট ছিলেন। সেখানে একতারা প্রতীকের কোনো এজেন্ট আসেননি বলে জানান প্রিজাইডিং কর্মকর্তা আওলাদ হোসেন। একইভাবে আরও অনেক কেন্দ্রে নৌকার পাশাপাশি একতারা, লাঙ্গল ও গোলাপ ফুল প্রতীকের এজেন্ট ছিল। যদিও হিরো আলম অভিযোগ করেন, অনেক কেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের মারধর করে বের করে দেওয়া হয়েছে।
বিজয়ে দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল : এদিকে নির্বাচনের পরে এক প্রতিক্রিয়ায় মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমরা দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। আমি যে প্রতিশ্রুতিগুলো দিয়েছিলাম তা নিয়ে ইতোমধ্যে চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছি। এখন থেকে কাজও শুরু করে দেব। আমি যেখানে গিয়ে যে প্রতিশ্রতি দিয়েছি, সেখানে আবার যাব। আমরা এই কর্মকাণ্ডে সবার সহযোগিতা চাই। তিনি আরও বলেন, পাঁচ মাসে সব কিছু করে ফেলব এটা আমি দাবি করছি না। তবে অনেক কিছু শুরু করে দেব। দৃশ্যমান হবে। আপনারাও দেখতে পাবেন। এরপর যদি আমি আবার দলের মনোনয়ন পাই এবং জনগণ যদি আবার ভোট দিয়ে বিজয়ী করে ধারাবাহিকভাবে এগুলো করতে থাকব।