স্টাফ রিপোর্টার :
গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলে এমন যেকোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তিনি বলেছেন গণতন্ত্রহীন অবস্থায় যে উন্নয়ন হয় তা কখনো সর্বজনীন হতে পারে না।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিকাল ৩টায় সংসদের বৈঠক শুরু হয়। বিকাল সোয়া ৩টায় রাষ্ট্রপতি ভাষণ শুরু করে ৩টা ৫৫ মিনিটে শেষ করেন। সংসদের এই বিশেষ অধিবেশনে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, তিন বাহিনী প্রধান, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বসহ সমাজের বিশিষ্টজন উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ এ মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে আমি আজ দলমত নির্বিশেষে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি-আসুন, সবার সম্মিলিত প্রয়াসে প্রিয় মাতৃভূমি থেকে সংঘাত-সংঘর্ষ এবং যেকোনো উগ্রবাদ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড হতে দূরে থেকে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনে শামিল হই। গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলে এমন যেকোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে।
তিনি বলেন, উন্নয়ন ও গণতন্ত্র একসঙ্গে চলে। দেশে গণতন্ত্র অব্যাহত থাকলে উন্নয়ন ও অগ্রগতি এগিয়ে যায়। আবার গণতন্ত্রের স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ হলে উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয়। উন্নয়নকে স্থায়ী ও টেকসই করতে হলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মজবুত করতে হবে, তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রের চর্চা ছড়িয়ে দিতে হবে। গণতন্ত্রহীন অবস্থায় যে উন্নয়ন হয় তা কখনো সর্বজনীন হতে পারে না। সে উন্নয়ন হয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক।
তিনি আরও বলেন, হিংসা-বিভেদ নয়, স্বার্থের সংঘাত নয়, আমাদের সামনে রয়েছে আজ দেশ গড়ার কাজ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা গড়ে দিয়ে যাব একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ-এ হোক আমাদের সবার অঙ্গীকার।
আবদুল হামিদ বলেন, গণতন্ত্র আমদানি বা রপ্তানিযোগ্য কোনো পণ্য বা সেবা নয়। মনে চাইল কোনো দেশ থেকে পরিমাণমতো গণতন্ত্র আমদানি বা রপ্তানি করলাম, বিষয়টি এমন নয়। চর্চার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র বিকশিত ও শক্তিশালী হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। ক্ষমতায় যাওয়া বা পরিবর্তন আনার একমাত্র উপায় নির্বাচন। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি কখনো দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। বরং তা রাজনৈতিক পরিবেশকে তমসাচ্ছন্ন করে তোলে। সংঘাত ভুলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে আমাদের সবার সহায়তা করা উচিত।
আবদুল হামিদ বলেন, রাজনীতি থেকে হিংসা-হানাহানি অবসানের মাধ্যমে একটি সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে হবে। প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মহান সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশের জনগণ নিরপেক্ষভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ ও বেগবান করবে-এটাই সবার প্রত্যাশা।
রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতীয় সংসদ গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এর পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীলতা এবং দৈনন্দিন নাগরিক জীবনের জরুরি ও জনগুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে সংসদ কার্যকর ভূমিকা পালন করবে, এটাই আশা করে জনগণ।
বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক বলেন, রাজনৈতিক মতপার্থক্য এবং নীতি-আদর্শের ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু সংসদকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার ক্ষেত্রে কোনো ভিন্নতা থাকতে পারে না। তাই আপনাদের প্রতি আমার আকুল আহ্বান সংসদকে কার্যকর করতে ঐক্যবদ্ধ হোন। আমাদের অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জাতীয় সংসদে সবস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এটি অর্জনে আমাদের সবসময় সচেষ্ট থাকতে হবে।
আবদুল হামিদ বলেন, পার্লামেন্টে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে স্পিকার অনেক সময় বিব্রত হতেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু হতেন না। ১৯৭৩ সালে পার্লামেন্টে আতাউর রহমান খান, এমএন লারমাসহ বিরোধী দলের কয়েকজন সদস্য ছিলেন। তখনও দেখেছি তারা কথা বলতে চাইলেই সুযোগ পেতেন এবং বঙ্গবন্ধুই স্পিকারকে বলে সে সুযোগ করে দিতেন। এটা ছিল বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর একটি গণতান্ত্রিক কৌশল। রাজনৈতিক মতাদর্শের যত অমিলই থাকুক না কেন বঙ্গবন্ধু বিরোধী দলের নেতাদের যথাযথ সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। আসলে রাজনীতিতে শিষ্টাচার ও পরমতসহিষ্ণুতার কোনো বিকল্প নেই।
রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় ও যোগ্য নেতৃত্বে বিগত দেড় দশকে দেশের প্রতিটি সেক্টরে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সত্ত্বেও বিশ্বে যে কয়েকটি দেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে সরকারের আর্থ-সামাজিক ও বিনিয়োগধর্মী নানামুখী প্রকল্প, কর্মসূচি এবং কার্যক্রম গ্রহণের ফলে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দারিদ্র্যের হার কমার পাশাপাশি মাথাপিছু আয় বেড়েছে। দেশের শতভাগ জনগণ বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী দেশে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও দেশের খাদ্যনিরাপত্তা সুরক্ষিত রয়েছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরেই মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে শূন্য থেকে দেশকে একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্রের হাতে বঙ্গবন্ধু শহিদ না হলে দেশ অনেক আগেই উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হতো। ’৭৫-এর পর উন্নয়ন ও গণতন্ত্র অনেক দিন অবরুদ্ধ ছিল। ফলে দেশ অনেক পিছিয়ে পড়ে। গত দেড় দশকে সরকার ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতার ফলে দেশ উন্নতি ও অগ্রগতির পথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এখন আমাদের দায়িত্ব উন্নয়নের এই ধারাকে এগিয়ে নেওয়া।
নিজের রাজনৈতিক জীবনের তথ্য তুলে ধরে আবদুল হামিদ বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাকে জাতীয় পরিষদে মনোনয়ন দিলেন। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু আমাকে মনোনয়ন না দিলে নিভৃত হাওড়ের আবদুল হামিদ হয়তোবা নিভৃতেই থেকে যেত। তাই রাষ্ট্রপতি হিসাবে নয়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন সৈনিক হিসাবে নিজেকে পরিচয় দিতেই আমি বেশি গর্ববোধ করি। প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) সেদিন আমাকে ডেপুটি স্পিকার পদে মনোনয়ন না দিলে হয়তোবা কিশোরগঞ্জকে ঘিরেই আমার রাজনীতি আবর্তিত হতো। বঙ্গবন্ধুর হাতে হয়েছিল আমার রাজনীতির হাতেখড়ি ও প্রথম উত্থান। আর ’৯৬ তে দ্বিতীয় উত্থান ঘটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে এবং তারই উদ্যোগে। রাষ্ট্রপতি হিসাবে এই ভাষণটি মহান জাতীয় সংসদে তার শেষ ভাষণ বলেও জানান তিনি।